শহীদ আহমদ খান :
স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে নতুন অধ্যায়ের সূচনা ঘটে। তখন সবার ধারণা ছিল—আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন নিয়ে সরকার গঠন করতে যাচ্ছে। কিন্তু ফলাফলে দেখা গেল উল্টো চিত্র—বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সরকার গঠন করে।
সেই নির্বাচনে সিলেট বিভাগের ১৯টি আসনের মধ্যে ১৮টি আসন জেতে আওয়ামী লীগ, শুধুমাত্র সিলেট-১ আসন ব্যতিক্রম। এই আসনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী, সিলেট বিএনপির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা নেতা খন্দকার আব্দুল মালিক বিপুল ভোটে বিজয়ী হন। এরপর থেকেই সিলেট-১ আসনটি হয়ে ওঠে এক মর্যাদাপূর্ণ প্রতীক—যেন সিলেটের এই আসন যার, সরকার হবে তার।
হযরত শাহজালাল (রহ.)-এর স্মৃতিবিজড়িত এই আসন নিয়ে এখনো সেই রাজনৈতিক প্রবাদ চলে আসছে, এবং গত ৩৫ বছরেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি।
🔸 আসন্ন নির্বাচনে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু: সিলেট-১
দীর্ঘ দেড় যুগের আওয়ামী শাসন পর্ব শেষে যখন অন্তর্বর্তী সরকার জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছে, তখন থেকেই সারা দেশের দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়েছে মর্যাদাপূর্ণ সিলেট-১ আসনে।
সরকার নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার পরপরই জামায়াতে ইসলামী তাদের প্রার্থী ঘোষণা করেছে এবং প্রার্থী মাঠে সরব। অপরদিকে বিএনপি এখনো প্রার্থী নির্ধারণের প্রক্রিয়ায় ব্যস্ত—চলছে জরিপ, চলছে আলোচনা।
কেউ বলছেন, এখানে প্রার্থী হবেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নিজে। কেউ বলছেন, ডা. জুবাইদা রহমান, সিলেটের মেয়ে, হতে পারেন দলের প্রতীকী প্রার্থী।
অন্যদিকে মাঠে আছেন ১৯৯১ সালের সেই বিজয়ী প্রয়াত এমপি খন্দকার আব্দুল মালিকের পুত্র খন্দকার আব্দুল মুক্তাদির—যিনি ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী ছিলেন, কিন্তু আওয়ামী লীগের রাতের ভোটের কাছে পরাজিত হন। তবুও তিনি মাঠ ছেড়ে যাননি। সরকারের নিপীড়ন উপেক্ষা করে তিনি নেতাকর্মীদের পাশে থেকে সংগঠন ধরে রেখেছেন, আন্দোলনের প্রথম সারিতে ছিলেন সব সময়।
🔸 মুক্তাদির বনাম আরিফ: নীরব প্রতিদ্বন্দ্বিতা
৫ আগস্ট ২০২৪-এর পটপরিবর্তনের পর খন্দকার মুক্তাদির দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ঘোষিত ৩১ দফা কর্মসূচি নিয়ে নির্বাচনী এলাকায় দিনরাত ব্যস্ত। অন্যদিকে, সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী-ও পিছিয়ে নেই। কেউ বলছেন, তিনি মেয়র পদে ফিরবেন, আবার কেউ বলেন, তিনি এবার এমপি পদে লড়বেন—তবে কোন আসনে তা এখনো স্পষ্ট নয়।
৭ অক্টোবর হযরত শাহজালালের মাজার জিয়ারতের মাধ্যমে খন্দকার মুক্তাদির তার নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেন। এরপর ১৫ অক্টোবর তিনি সংক্ষিপ্ত সফরে আমেরিকা যান। তার অনুপস্থিতিতে ২২ অক্টোবর একই কায়দায় মাজার জিয়ারত ও শোডাউনের মাধ্যমে আরিফুল হক চৌধুরীও জানান দেন—তিনি সিলেট-১ আসনের প্রার্থী হচ্ছেন।
🔸 জল্পনা এখনো অব্যাহত
এখন সিলেটবাসীর মুখে একটাই প্রশ্ন—সিলেট-১ আসনে বিএনপির প্রার্থী কে?
এই জল্পনা-কল্পনার মধ্যেই নগর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি, সাবেক ছাত্রনেতা রেজাউল হাসান কয়েস লুদি পরিষ্কার জানিয়েছেন—
“সিলেট-১ আসনে বিএনপির প্রার্থী হচ্ছেন খন্দকার মুক্তাদির।”
অন্যদিকে, বিএনপির কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মিফতা সিদ্দিকী জানিয়েছেন,
“খুব শীঘ্রই এ বিষয়ে দলের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হবে। তবে প্রার্থী যেই হোন না কেন, আমরা ধানের শীষের পক্ষে একজোট হয়ে কাজ করব।”
সিলেট-১ এখন শুধুমাত্র একটি আসন নয়—এটি রাজনৈতিক মর্যাদার প্রতীক, অতীত ঐতিহ্যের ধারক, এবং জাতীয় রাজনীতির দিকনির্দেশক এক প্রতিযোগিতার মঞ্চ। এবারও সারা দেশের চোখ থাকবে শাহজালালের শহরের এই আসনের দিকে—দেখার জন্য, আবারও কি ইতিহাসের রেওয়াজ অটুট থাকে?
